হয় ইউরোপ নয় মৃত্যু----------চতুর্থ ও শেষ পর্ব
দালালের গেইমে সার্বিয়া থেকে ঝুঁকিপথে ইউরোপে
সাব্বির আহমেদ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
ঢাকা: দালালের গেইমে পড়ে আব্দুর রহমানসহ অভিভাসন প্রত্যাশী
৫০ জনের বহর নিয়ে গাড়ি থেমেছে একটি জঙ্গলের পাশে। তখন মাত্র সন্ধ্যা নেমেছে। গাড়ি থামানোর
সঙ্গে সঙ্গে তাদের জঙ্গলের দিকে দৌড় দিতে বলা হয়। নামার সাথে সাথেই তারা দেখেন এখানে
বরফ আর কাঁদা, উচু নিুচ জায়গা। আর জঙ্গল পুরোটা লেবু গাছের মত কাঁটায় ঢাকা।
পাকিস্তানে দু’জন লাইনম্যান (দালালদের সহযোগি) সেই জঙ্গলে আঘঘন্টা
পর পর একটু বিশ্রাম নেয়ার সুযোগ দেয় তাদের। কনকনে শীতের মধ্যে এভাবে মধ্যরাত পর্যন্ত
হাটার পর একটি কাঁটাতারের কাছে পৌঁছে তারা বুঝতে পারেন কোন দেশের সীমান্তে এসে গেছেন
তারা।
লাইনম্যান তখন ম্যাপ দেখে বলে এটা সার্বিয়া বর্ডার। বর্ডারের
কাছাকাছি হওয়া মাত্র কুকুরে ডাকে তাদের থামতে হয়। লুকাতে হয় আবার পেছনের জঙ্গলে। পরে
কুকুরের ডাক থামার পর সার্বিয়া বর্ডার পার হয়ে প্রধান সড়ক ধরে হাঁটা শুরু করেন তারা।
এবার তাদের গ্রুপের সবাই সিদ্ধান্ত নেন পুলিশের কাছে ধরা দেবেন।
বুলগেরিয়ায় তারা পাসপোর্ট সহ সব কিছু ফেলে এসেছেন। এখানে তাদের হাতে কোন ডকুমেন্ট নেই।
সার্বিয়ায় বাংলাদেশী পরিচয় দিলে ফেরত পাঠানো হয় বলে নিজেকে
আফগানের বাসিন্দা পরিচয় দেন আব্দুর রহমান। সার্বিয়ার পুলিশ একটি ক্যাম্পে তাদের রেখে
৩ দিনের অবস্থানের একটি কাগজ দিয়ে ক্রোয়েশিয়া পাঠিয়ে দেয়ার জন্য বাসে তুলে দেয়। তখন
ক্রোয়েশিয়া অভিবাসীদের জন্য কিছুটা নমনীয় হয়েছে।
কিন্তু আব্দুর রহমান সহ তাদের পুরো গ্রুপ সার্বিয়ার রাজধানীতে
নেমে ইতালি জার্মানি পথ ধরতে আরেক দালালের মাধ্যমে এক হাজার ইউরোতে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায়
যাবার চুক্তি করেন। সার্বিয়া থেকে হাঙ্গেরি বর্ডারের কাছে ভুট্টা ক্ষেত পাড়ি দিয়ে হাঙ্গেরির
বর্ডার ঢুকার চেষ্টা করছেন তারা।
কিন্তু বর্ডার কড়াকাড়ি আরোপ করেছে হাঙ্গেরি। জ্বলছে পুলিশের
টর্চ লাইট। জঙ্গলের মধ্যে গভীর রাতে তারা কাঁটাতার কেটে ঢুকবেন। এই হিসেবে রাত ৩ টার
দিকে তারা আবার চেষ্টা করবেন ঢুকার। কিন্তু এ চেষ্টায়ও ব্যর্থ হয়ে ভুট্টা ক্ষেত্রের
মধ্যে প্রচন্ড শীতের জুবুথুবু হয়ে লুকিয়ে অবস্থান নেন তারা।
তখন তাদের সঙ্গে থাকা দালাল জানায়, সকাল ৭ টায় পুলিশের ডিউটি
পরিবর্তন হয় তখন তাঁর কেটে সীমান্তে ঢুকে পড়তে হবে।
পরে সকাল ৭ টায় ভুট্টার ক্ষেত পেরিয়ে লাইনম্যান কাঁটাতার কেটে
দেয়া মাত্রই তাদের ২৮ জনের মধ্যে ৮ জন ঢুকতে পারেন। এরমধ্যে পুলিশে দেখে ফেলে। পরে
৮ জনের মধ্যে একজন পাকিস্তানী দৌড় দিয়ে পালিয়ে যায় আর আব্দুর রহমান সহ বাকি ৭ জন ধরা
পড়েন পুলিশের হাতে।
হাঙ্গেরি বর্ডারে পুলিশে হাতে আটক হওয়ার পর তাদেরকে পুলিশ স্টেশনে
নিয়ে মোবাইল সিম, ব্যাটারি, টাকার নাম্বারসহ লিখে রাখা হয়। পরে মেডিকেল টেস্ট করতে
নিয়ে যায় পুলিশ। পরে তিনদিন জেলে রেখে অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে আদালতে তোলা হয়।
তখন তারা অপরাধ স্বীকার করে হাঙ্গেরিতে থাকার অনুরোধ করলে ১৪
দিনের অবস্থানের একটি কাগজ ধরিয়ে দিয়ে এক বছরের জন্য হাঙ্গেরিতে নিষিদ্ধ করা হয় তাদের।
এরপর তারা তারা ট্রেনে হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্ট, এবং সেখান
থেকে হাঙ্গেরির গেওর শহর আরও অনেক বাংলাদেশী ইরাক ইরান সোমালিয়া, নেপাল ও আফগানিস্তানী
শরনার্থীদের সঙ্গে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় যেতে একটি গাড়িতে তিনি।
আড়াইঘন্টা পর টেক্সিযোগে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় পৌঁছে যান আব্দুর
রহমান। টেক্সিকে তাদের ২৫০ ইউরো দিতে হয়। সেখান থেকে ট্রেনে আব্দুর রহমান পৌঁছে গেছেন
ইতালির মিলান শহরে। কিন্তু অস্ট্রিয়ার সীমান্ত পার হওয়ার পরই ইতালির পুলিশ ট্রেনে তাদের
পাসপোর্ট সহ কোন কাগজপত্র না থাকায় তাদের আটক করে। পরে তাদের ছেড়ে দেয়। আবার ট্রেনে
চড়ে মিলান এসে পৌঁছান আব্দুর রহমান। তবে এ যাত্রায় আর কোন বাংলাদেশী যেন না যায়-সেই
অনুরোধ তারা ।
আব্দুর রহমান সাইপ্রাস ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন ২০ জানুয়ারি এরপর
বিপদসংকুল পথ মাড়িয়ে ইতালি যখন পৌঁছৈন তখন ২১ ফেব্রুয়ারি।
তার মত আরও অনেকেই পৌঁছতে পারেনি আর অর্থকষ্টে সাইপ্রাস থেকে
বের হতে চাচ্ছে অনেক বাংলাদেশী-বলে জানান আব্দুর রহমান। যাদেরও গন্তব্য হয় ইউরোপ নয়
মৃত্যু।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৩৫ ঘণ্টা, ০২ এপ্রিল ২০১৬
এসএ/


No comments:
Post a Comment