হয় ইউরোপ, নয় মৃত্যু------------১
সমুদ্রে ভেসে ইউরোপ যাত্রা বাংলাদেশীর
সাব্বির আহমেদ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
ঢাকা:
উত্তাল সমুদ্রে ভাসছে নৌকা। প্রবল ঢেউয়ের তোড়ে নৌকায়
পানি উঠতে শুরু করেছে। নৌকা ঘিরে চলছে হাঙ্গর ও ডলফিন। নৌকার মানুষগুলোর মৃত্যু হলেই
গিলে ফেলবে হাঙ্গার! ভাগ্য বদলের আশায় লিবিয়ার জোয়ারা উপকূল থেকে দু:সহ সাগরে ভাসছেন
বাংলাদেশের রবিউলসহ ৮০ জন। গন্তব্য ইউরোপে পাড়ি জমানো। কিন্তু ইউরোপ নয় মৃত্যু এখন
তাদের খুব কাছে। ডুবছে নৌকা… সেই নৌকায় সোমালিয়া, ক্যামেরুন কালো চামড়ায় মানুষের ভিড়ে
আছেন রবিউলদের কান্না কি শুনতে পাচ্ছে কেউ…
অবৈধ পথে মৃত্যু সাথে নিয়ে সেই দু:সহ ইউরোপ যাত্রা এখনও থেমে
নেই। গেল বছরে বিশ্বে সবচেয়ে আলোচিত এই অভিবাসী সংকট এ বছরও ধারাবাহিকা রেখে চলছে।
সাইপ্রাস থেকে বুলগেরিয়া, সার্বিয়া, অস্ট্রিয়া হয়ে ইউরোপের উন্নত জীবনের দেশগুলোতে যেতে এখনও যেমন পথে আছে অনেকেই। তেমনি
লিবিয়া উপকূল থেকে সাগরপথে মৃত্যৃপথেই যেতে ইউরোপ যেতে চাচ্ছেন অনেকেই। এদের মধ্যে
উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় আছেন বাংলাদেশেীও।
এ বছরের শুরুতেই এ যাত্রায় শামিল হওয়া বাংলাদেশী রবিউল আর সুমনের
ভয়াল যাত্রার কাহিনী নিয়ে বাংলানিউজের এই বিশেষ প্রতিবেদন। প্রতিবেদনের দ্বিতীয় ও শেষ
পর্বে থাকছে স্থলপথে এক দেশ থেকে আরেক দেশের জঙ্গল বরফ মাড়িয়ে কাঁটাতার কেড়ে সীমান্ত
পেরিয়ে ইউরোপ যাত্রার কাহিনী।
বেকার জীবনের হতাশা আর পরিবারের দূরাবস্থায় ছোটভাইকে নিয়ে ইউরোপ
যাবার মনস্থ করেন রবিউল। কথা হয় দালালের সঙ্গে। জনপ্রতি সাড়ে ৫ লাখ টাকার চুক্তিতে
লিবিয়া যাবেন রবিউল। সঙ্গে তার ছোট ভাই। ঢাকার ফকিরাপুলের ‘আন্তর্জাতিক ট্যুর ট্রাভেলসে’র
মাধ্যমে এই চুক্তি হয়। ওই ট্রাভেলস তাদের চট্রগ্রাম নিয়ে আসে। এখানে ‘মায়ামী হোটেল’-এ
১৫ দিন রেখে শাহ আমানত এয়ারপোর্ট থেকে ফ্লাইটে দুবাই, মিশর, তিউনিস হয়ে লিবিয়ায় নিয়ে
আসা হয় রবিউলসহ বাংলাদেশী প্রায় অর্ধশত যুবককে। লিবিয়ায় পৌঁছে সন্দেহে পড়ায় দালাল পরিবর্তন
করেন রবিউল। এসময় প্রায় তিনমাস লিবিয়ায় অবস্থান করে উপায় না দেখে নতুন দালালের মাধ্যমে
দেড়লাখ টাকা দিয়ে ইতালির উদ্দেশ্যে সাগরে নামতে বাধ্য হন তিনি।
ঝুঁকিপূর্ণ ও বিপদসংকুল ভুমধধ্যসাগর মাড়িয়ে এবার সাগর পথে ইউরোপ
যাবার পথে রবিউল।
এখন যে দালালের সঙ্গে চুক্তি করছেন সেই দালাল তাকে নিয়ে রওয়ানা
হয়েছে লিবিয়ার জোয়ারা শহরে। ওই শহরের সমুদ্র উপকূল থেকে সাগরপথে স্বপ্নের ইউরোপে যাবেন
রবিউল। কিন্তু আসলে কি ইউরোপে যাচ্ছেন! ইউরোপও তো আরও দূর। এখানে সবচেয়ে কাছে যেন মৃত্যু।
আগে এটা জানতেন না এটা রবিউল। জানলে নিজের শুত্রুকেও এই বিপদে ফেলতেন না। তখন মনে মনে
ভেবেছিলেন, ‘সাগরে সলিল সমাধিই ছিলো তার কপালে’।
রবিউল এখন জোয়ারা শহরের একটি ক্যাম্পে। এটাকে ট্রানজিট ক্যাম্প
বলা হয়। এখান থেকেই নৌকায় ভাসিয়ে দেয়া হয় প্রতি রাতে। কোন রাতে ৪০০ কোন রাতে ৫০০ আর
কোন রাতে ৭০০ জনকে নিয়ে নৌকায় একটি রাডার লাগিয়ে দিয়ে ভাসিয়ে দেয়া হয় রবিউলের মতো ভাগ্য
বদলের আশায় ইউরোপগামীদের।
তারপর কেউ কেউ সাগর থেকে উদ্ধার হয়। শরনার্থী হিসেবে তাদের
আশ্রয় দেয় ইতালি জার্মানী। কিন্তু অনেকের ভাগ্যে শরনার্থী দূরে থাকে শব দেহটাও মিলে
না। মিশে যেতে হয় সাগরে। নৌকা ডুবে সলিল সমাধি হয় শেষ ঠিকানা।
এখন জোয়ারা ট্রানজিট ক্যাম্পে অপেক্ষা করছেন রবিউল। এখানে না
আছে বসার মতো জায়গা না আছে সামান্য পানি খাওয়ার কোন ব্যবস্থা। আগে জানলে কখনই এপথে
পা বাড়াতেন না- ট্রানজিট ক্যাম্পের ছাউনি তলে বসে বসে তাই ভাবছিলেন। সঙ্গে আছে ছোট
ভাই। তার কথাও চিন্তা করছেন। এখনও বয়সে শিশু ছোটভাইকে নিয়ে যেতে পারবেন তো ইউরোপ…
রবিউলের নৌকা ৪০০ জনের জন্য অপেক্ষা করছে। আর জোয়ারা ক্যাম্পে
ভোর রাতের আগেই দলে দলে লোক আসছে। ভুমধ্যসাগর পাড়ি দিতে এখানে এভাবে প্রতিরাতের ভিড়
জমে যায। এদের মধ্যে আরও প্রায় ২০ জন বাংলাদেশীকে খুঁজে পেলেন রবিউল।
এখন যারা রবিউলের চারপাশে হাটাচলা করছে তাদের বেশিরভাগই কালো
চামড়ার। চেহারা দেখেই বোঝে নেয়া যাচ্ছে এরা এসেছে আফ্রিকার কোন দেশকে। কথা বলার মাধ্যমে
যতটুকু জানতে পারলেন তা হলো- তিনি যেমন ইউরোপের স্বপ্নে বাংলাদেশ থেকে দালাল ধরে এসেছেনে
তেমনি তারাও মরুভূমির পথে প্রখর সূর্যের উত্তাপ মাড়িয়ে ট্রাক পিকআপ ভ্যান আর লরিতে
গাদাগাদি করে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশকে লিবিয়া সীমান্ত পাড়ি দিয়ে এখানে এসেছে। উদ্দেশ্য
একই সাগরপথে ইউরোপ যাত্রা।
ট্রানজিট ক্যাম্পে বেশ কয়েকজনের সঙ্গে উঠাবসা করে রবিউল নিশ্চিত
হন, পশ্চিম মধ্য আফ্রিকা থেকেই এসেছে তারা। চাকরি আর উন্নত জীবনের সুযোগ না থাকায় যুদ্ধবিধ্বস্ত
এসব দেশের অনেকেই রবিউলের মতো ইউরোপের উন্নত জীবনে যেতে এখন মুত্যুঝুঁকির সামনে।
ক্যামেরুন থেকে আসা একজনের সঙ্গে কথা শুনিয়ে রবিউল বলেন, ক্যামেরুনের
ওই নাগরিক তাকে জানিয়েছেন, তার লক্ষ্য ডেনমার্ক যাওয়া। উগ্রপন্থি বুকো হারামের দ্বারা
বিপর্যস্ত হয়েছে তার পরিবার। চরম হতাশা অর্থনৈতিক কষ্টে তিনি সাগর পাড়ি দিয়ে হলেও যেতে
চান।
ট্রানজিট ক্যম্পে ঘুরে ঘুরে রবিউল নিশ্চিত হন, দালালরা আসলে
দেশ ভিত্তিক টাকার চুক্তি করে। এখানে সেনেগাল, নাইরেজরিয়া, গাম্বিয়া থেকে যারা এসেছে
তাদেরকে লিবিয়া সীমান্ত পর্যন্ত নিয়ে যেতে ২১৫ ডলার নেয়া হয়েছে । অর্থাৎ একেক দেশের
নাগরিকদের জন্য একের রেট ধার্য্য করে দালালরা।
এদিকে ডাক পড়েছে রবিউলের। ১২ দিন জোয়ারা উপকূলে দালালের ক্যাম্পে
অবস্থানের পর নৌকার উঠার আগেই তাকে দিতে হয়েছে দেড়লক্ষ টাকা। এখন হয় মৃত্যু নয় ইউরোপে
পথে এবারের যাত্রা। সমুদ্রে বুক পানি পর্যন্ত হেটে গিয়ে একটি স্পিবোর্টে উঠলেন রবিউল
তারপর স্পিডবোর্ড কিছুদূর গিয়ে একটি নৌকায় তুলে দেয় তাকে।
আগামী
পর্বে পড়ুন নৌকায় দু:সহ সময় যেভাবে কেটেছে রবিউলের। উদ্ধারও হতে কি পারলেন তিনি। যেতে
পারলেন কি ইউরোপ ইতালিতে না হাঙ্গরের পেটে…
বাংলাদেশ সময়: ১৩৩৫ ঘণ্টা, ০২ এপ্রিল ২০১৬
এসএ/



No comments:
Post a Comment